দেশপ্রেম (পাঠ ৬)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - খ্রীষ্টধর্ম শিক্ষা ক্ষমা, সহনশীলতা ও দেশপ্রেম | - | NCTB BOOK
67
67

নিজ দেশের প্রতি গভীর অনুরাগ বা ভালোবাসাকে দেশপ্রেম বলা হয়। দেশপ্রেমের সাথে জড়িত থাকে জাতীয়তাবোধ। প্রত্যেক দেশের মানুষের মধ্যেই দেশের প্রতি একটা আকর্ষণ থাকে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর 'বঙ্গভাষা' কবিতায় ভালোবাসার কথা অত্যন্ত চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন:

হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন:-

তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,

পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ

পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!

অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,

মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি;-

কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!

স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে,

-"ওরে বাছা মাতৃ-কোষে রতনের রাজি,

এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?

যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!

পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে

মাতৃ-ভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে।।

কপোতাক্ষ নদ কবিতায় মাইকেল মধুসূদন বলেন:

সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;

জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!-

বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,

সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে

শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে

কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?

ইংরেজ কবি সামুয়েল জনসন বলেছেন দেশপ্রেম বলতে বোঝায় 'দুরাচারী ব্যক্তির সর্বশেষ আশ্রয়স্থল'। এর দ্বারা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, সব মানুষের এমনকি দুর্বৃত্ত বা দুরাচারী ধরনের ব্যক্তিরও একটা আশ্রয়স্থল দরকার। আর সেই আশ্রয়স্থল হলো তার মাতৃভূমি তার আপন দেশ।

মা-মাটি-মাতৃভূমি এই তিন 'ম' যে কোনো মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় শব্দ। এই তিনকে ভালোবাসাই হলো দেশপ্রেম। দেশের মাটির ফসল, ফলমূল মানুষের জীবন বাঁচায়, দেশের বন-বনানী ও প্রকৃতি পরম মমতায় উদারভাবে আমাদের প্রয়োজন মেটায়। তাইতো দেশের প্রতি আমাদের মনে মমতা সৃষ্টি হয়। দেশের প্রতি মমত্ববোধও দেশপ্রেম নিয়ে আমরা সব কাজ করব। তাই তো জাতীয় সংগীতে আমরা গেয়ে উঠি:

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।

পবিত্র বাইবেলে দেশপ্রেম সম্পর্কে শিক্ষা

"যাঁদের হাতে রয়েছে শাসন করার অধিকার, সকলেই যেন তাঁদের অনুগত হয়ে থাকে, কেননা তেমন কর্তৃত্বের অধিকার মাত্রই আসে পরমেশ্বরের কাছ থেকে। যাঁদের হাতে কর্তৃত্বের দায়িত্ব রয়েছে, তাঁরা তাঁর কাছ থেকেই তা পেয়েছেন। আর তাই তো কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা যে করে, সে কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বর যা স্থির করে রেখেছেন, তারই বিরোধিতা করে। তেমন বিরোধিতা যারা করে, তারা নিজেরা নিজেদের ওপর শাস্তি ডেকে আনবেই। যাঁরা ভালো কাজ করে, তাদের তো শাসকদের ভয় পাবার কোনো কারণই থাকে না। ভয় পাবার কারণ থাকে বরং তাদেরই, যারা মন্দ কাজ করে। কর্তৃপক্ষের কাউকে তুমি ভয় পাবে না, তুমি কি তেমনটি চাও? বেশ তো, যা ভালো, তাই কর। তাহলে তুমি তো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রশংসাই পাবে। আসলে তাঁরা তো ঈশ্বরেরই নিয়োজিত সেবাকর্মী- তোমার মঙ্গল করার জন্যেই নিয়োজিত তাঁরা। কিন্তু তুমি যদি মন্দ কাজ কর, তাহলে তোমার ভয় পাবার কারণ অবশ্যই আছে। তাঁরা তো শুধু শুধু তলোয়ার সঙ্গে বয়ে নিয়ে বেড়ান না; তাঁরা তো ঈশ্বরের সেবক: যারা মন্দ কাজ করে, তাদের ওপর ঐশ ক্রোধের আঘাত হানার দায়িত্ব তাঁদেরই হাতে রয়েছে। সুতরাং তাঁদের প্রতি তোমাদের অনুগত হয়ে থাকতেই হবে-শুধুমাত্র ঐশ ক্রোধের আঘাতকে ভয় পাও বলেই নয়, বিবেককে মান্য কর বলেই" (রোমীয় ১৩:১-৫)।

এর মধ্য দিয়ে সাধু পল আমাদের কাছে বলতে চান যে আমরা যেন শাসনকর্তাদের ভালোবাসার মাধ্যমে দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করি। কারণ শাসকগণ ঈশ্বরেরই সেবক। কাজেই ভালোবাসা আছে বলে আমরা কোনো ভয় যেন না পাই। যারা মন্দ কাজ করে তাদের মধ্যে দেশের প্রতি ভালোবাসার অভাব আছে। তারা শাসকদেরও ভয় পায়।

সামসংগীত লেখক লিখেছেন:

ধন্য সেই জাতি, ঈশ্বর যার আপন প্রভু;

ধন্য সেই জনসমাজ, যাকে নিজেরই জাতি-রূপে তিনি করেছেন মনোনীত!

ঈশ্বর তো স্বর্গ থেকে তাকিয়ে দেখেন;

সব মানুষকে দেখতেই পান তিনি।
সুবিপুল রাজবাহিনী রাজাকে বাঁচাতে পারে না;

যোদ্ধার মহা বাহুশক্তিও সেই যোদ্ধাকে রক্ষা করতে পারে না।

যুদ্ধ-অশ্ব সম্বল করে জয়ের আশা তো বৃথা;

সেই অশ্বের যত তেজ থাক, কাউকে বাঁচাতে পারে না।

ঈশ্বরের দৃষ্টি কিন্তু নিয়ত তাদেরই প্রতি,

তাঁকে সম্ভ্রম করে যারা, তাঁরই কৃপা-প্রত্যাশী যারা।

তাদের তিনি তো মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করবেন,

প্রাণ বাঁচাবেন দুর্ভিক্ষের দিনে। (সাম ৩৩: ১২-২২)

এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, প্রত্যেক দেশের মানুষ যেন ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করে। কারণ ঈশ্বরই তাদের লালনপালন ও রক্ষা করেন। ঈশ্বরের শক্তিতেই তাঁরা বিপদআপদ ও শত্রুদের কবল থেকে রক্ষা পায়।

সাধু পিতর তাঁর প্রথম ধর্মগ্রন্থে বলেন, "তোমরা কিন্তু এক মনোনীত বংশ, এক রাজকীয় যাজক-সমাজ, এক পবিত্র জাতি, একান্তভাবে পরমেশ্বরেরই আপন জাতি। তোমরা এজন্যেই মনোনীত, যাতে তোমাদের যিনি অন্ধকার থেকে তাঁর অপরূপ আলোকে আহ্বান করেছেন, তাঁরই সমস্ত মহাকীর্তির কথা তোমরা যেন প্রচার করতে পার। এককালে কোনো জাতিই ছিলে না তোমরা, কিন্তু আজ হয়ে উঠেছ স্বয়ং পরমেশ্বরেরই জাতি; এককালে তাঁর করুণার পাত্রও ছিলে না তোমরা কিন্তু আজ তোমরা, তাঁর করুণা পেয়েই গেছ” (১পিতর ২:৯-১০)।

সাধু পিতর আমাদের বলতে চান যে, আধ্যাত্মিকভাবে আমরা ঈশ্বরের আপন জাতি। যদি আমরা তাঁর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা বজায় রাখি, যদি তাঁর সব নিয়মকানুন পালন করে চলি তবেই আমরা তাঁর আপন জাতি।

Content added By
Promotion